আফতাবুল হক : এরকম অনেক মানুষ পাবেন এখন। যারা গত জুলাইয়ে শতভাগ চেয়েছিল বিগত সরকারের নিগড় থেকে মুক্তি পেতে। চেয়েছিল দুর্নীতি, দুঃশাসনের দুর্বিষহ শৃঙ্খল ভাঙতে। তারাই এখন বর্তমানের “নতুন অবন্দোবস্তের” সমালোচনা করে। যারা দেড় দশক দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে ছিল, তারা বছর পেরোনোর আগেই অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই।
অপেক্ষা দীর্ঘ ছিল বলেই এই মানুষগুলোর আকাঙ্ক্ষাও ছিল বড়। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের ধারে কাছেও নেই বর্তমান ব্যবস্থা। যেটাকে অব্যবস্থা বললে অতিশয়োক্তি হবে না।
যারা একসময় আম্লিকরে সমালোচনা করেছে সরবে বা নিভৃতে, তারা এখনকার অব্যবস্থা, নিপীড়ন, অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে কথা বললেই আম্লিকের দালাল, পাশের দেশের এজেন্ট বলে গালি খায়। যেমন আগে আম্লিকের বিরুদ্ধাচরণ করলেই রাজাকার, পাকির দালাল বলে গালি খেতে হত।
এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আম্লিক, বিম্পি, জাশি এবং নব্য মাতবর, একরাশ হতাশার ওপর নাম এন্সিপি ছাড়াও দেশে অগণিত মানুষ আছে। তারা সাধারণ মানুষ। আমজনতা। আমি, তুমি, আপনি, আমরা। যারা সচিবালয়, যমুনা চেনে না, ওখানে যেতেও চায় না। এমনকি ঢাকাতেও যেতে চায় না। তারা শান্তি চায়। পরিবারের ভোরন-পোষন, উন্নতি চায়। ন্যায় বিচার, সুচিকিৎসা চায়। ছেলে মেয়ের সুশিক্ষা চায়। পকেটে উপরি পয়সা না থাকলেও সন্মানের জীবন চায়। মাঝে মধ্যে আমোদ ফুর্তি আর প্রাণখুলে হাসতে চায়। পাঁচ বছর পরপর নিজেদের পছন্দ মত গভমেন্ট চায়। সর্বোপরি দেশের মঙ্গল চায়। সত্যিকার অর্থেই চায়। দেশের সাধারণ মানুষ কি ভালো আছে? নাকি তারা অনন্তকাল এক অদৃশ্য যাঁতাকলে পিষ্ট হতেই থাকবে?
সমাজ, রাজনীতি, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বাইনারি নিয়মে চলে না। আগে খারাপ ছিলাম বলে এখন যাই হোক না কেন তাই ভালো—এটা ফালতু আলাপ। দুই বা ততোধিক খারাপ পরপর থাকতে পারে। আগের চেয়ে আরও খারাপ হতে পারে। তার মানে এই না যে আগেই ভালো ছিলাম। শুধুমাত্র দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠাতেই যদি স্বস্তি খুঁজে নিই, তাহলে জেগে ওঠার সার্থকতা কোথায়, যদি নতুন সূর্যোদয় না আসে? নয় মাসে নতুন সূর্য তো দূরে থাক, টিমটিম করে জ্বলা তারা গুলোও নিভে গেছে। আগেও খারাপ, এখনও খারাপ—আমাদের কপালটাই খারাপ, এটাই কি আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না!?
এখন প্রশ্ন করলেও কিছু লোকজন ত্যারছা চোখে তাকায়। গালি দেয়। কেউ মনে মনে, অনেকে প্রকাশ্যে। এমনকি কিছু “বন্ধু”রাও।
নতুন স্বাধীনতার নির্যাস যদি হয় সেই একমত, একদল আর একনায়ক – তাহলে তফাতটা কোথায়? গালি না দিয়ে, ট্যাগ না লাগিয়ে বুঝিয়ে বলেন। নিজেকেও প্রশ্ন করুন, আপনার চিন্তাভাবনার সংস্কার কি হয়েছে? নাকি আপনি মানুষের মুক্তির স্লোগান দিয়ে শুধুমাত্র নিজের উগ্র মতবাদের প্রতিষ্ঠা এবং বিস্তার চেয়েছেন? তাহলে আপনাতে এবং গত দেড় দশকের আম্লিকের ফারাকটা কোথায়?
মুক্তিযুদ্ধে সত্যিকার অর্থেই রক্ত-মাংসে গড়া প্রিয়জন হারিয়েছি—চিহ্নিত আলবদর, রাজাকারদের প্রকাশ্য সহায়তায়। আমার মরহুম দাদা তাঁর কন্যার জন্য রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃতি চাননি। একজন আত্মসম্মানবোধধারী, গ্রেসফুল সাধারণের অবয়বে অসাধারণ মানুষ। তাঁর চেয়ে বেশি আপাদমস্তক বাংলাদেশি নেই। এরকম অজস্র বাংলাদেশি আছেন দেশের প্রান্তে প্রান্তে। তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করুন—তাঁরা কেমন আছেন। “বিপ্লব” মানে যদি হয় আত্মস্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধীদের হুঙ্কার, ফের দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য – তবে সেই বিপ্লব ধুয়ে পানি খেয়ে কি লাভ?
ফেসবুকের আন্দোলন, ভণ্ডামি, চতুরতা, গালাগালি, এক্টিভিজমের নামে নোংরামি আর উগ্রতা, ভার্চুয়াল বিপ্লবের সুবিধাভোগ—জনগণ এগুলোর থেকে অনেক অনেক দূরে। আগেও যত দূরে ছিল, এখনও। মাঝখানে কিছু তাজা রক্ত ঝরেছে। এটুকুই। কিন্তু ঐ ‘ওটুকুই’ যে অনেকের সবটুকু ছিল—আজকের সুবিধাভোগীরা তা জেনেও জানে না। বুঝেও না বোঝার ভান করে। শুধু সময়মতো গলার রগ ফুলিয়ে চেতনার স্লোগান দেয়। আগেও যেমন চেতনার ফেরি হত, এখনও তাই হয়। শুধু ফেরিওয়ালা পাল্টে গেছে।
জয় বাংলা, ইনকিলাব – স্লোগান পাল্টায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিচার, সাম্য, অর্থনৈতিক মুক্তি, জনগণের ভাগ্য যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যায়।
এখন বলেন, আমি কার দালাল? কষ্ট করে লিখতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি।
আমি বাংলাদেশের দালাল।